সাকিবের মোনার্ক মার্টকে শোকজ

সাকিবের মোনার্ক মার্টকে শোকজ

ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের মালিকানাধীন ই-কমার্সভিত্তিক মার্কেটপ্লেস মোনার্ক মার্ট নিয়ে নতুন বিতর্ক দেখা দিয়েছে। অনুমোদনহীন গিফট কার্ড, ক্যাশ ভাউচার বিক্রির জেরে প্রতিষ্ঠানটিকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ই-কমার্স সেল। পাশাপাশি বকেয়া বেতন ও ছাড়পত্র বুঝিয়ে না দিয়েই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে হুটহাট ছাঁটাইয়ের অভিযোগ করছেন সাবেক কর্মীরা। প্রতিষ্ঠিত ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের নিয়ে এসে নিয়োগের দুই মাসের মধ্যেই আবার পদত্যাগপত্র চাওয়ার অভিযোগও রয়েছে মোনার্ক মার্টের বিরুদ্ধে।

অনুমোদনহীন গিফট কার্ড কাণ্ডে কারণ দর্শানোর নোটিশ : ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা-২০২১-এর ৩.১.৯ ধারা অনুযায়ী, গিফট কার্ড, ক্যাশ ভাউচারের মতো পণ্য বা সেবা বিক্রি করতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পূর্ব-অনুমতি নিতে হয়। গত নভেম্বরে মোনার্ক মার্টসহ পাঁচটি

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকে এসব পণ্য বা সেবা অনুমোদন ছাড়া বিক্রি বন্ধের জন্য চিঠি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ই-কমার্স সেল। তখন এ বিষয়ে দৈনিক কালবেলাসহ দেশের গণমাধ্যমগুলোয় সংবাদও প্রকাশিত হয়।

মন্ত্রণালয়ের চিঠি এবং গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের জেরে বাকি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো গিফট কার্ড, ক্যাশ ভাউচার বিক্রি বন্ধ করলেও ব্যতিক্রম মোনার্ক মার্ট। এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত মোনার্ক মার্টে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের গিফট কার্ড, গিফট ভাউচার বিক্রি হচ্ছে। এ বিষয়ে গত ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় ই-কমার্স সেল প্রতিষ্ঠানটিকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে। মোনার্ক মার্টের সাবেক এক কর্মকর্তা জানান, প্রতি মাসের মোট বিক্রির প্রায় ৮২-৯০ শতাংশই আসে গিফট কার্ড বা ভাউচার থেকে।

এ বিষয়ে ই-কমার্স সেলের মুহাম্মদ সাঈদ আলী কালবেলাকে বলেন, তাদের আমরা প্রথমে চিঠি, এরপর কারণ দর্শানোর নোটিশ দিই। সেই নোটিশের একটি জবাব তারা আমাদের দিয়েছে। সেটি ফাইলে নথিভুক্ত করা হয়েছে। তাদের জবাব পর্যালোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

গিফট কার্ডের মতো পণ্য বা সেবা বিক্রির আগে যাদের অনুমোদন নিতে হবে সেই বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, এখন পর্যন্ত তারা কোনো প্রতিষ্ঠানকে এ ধরনের অনুমতি দেয়নি। তবে অনুমোদনের জন্য আবেদন করেছে তিনটি প্রতিষ্ঠান, যার মধ্যে মোনার্ক মার্ট নেই।

গিফট কার্ড বিক্রি সম্পর্কে জানতে মোনার্ক মার্টের পরিচালক জাহিদ কামালের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে প্রতিষ্ঠানটির অফিসে আসতে বলা হয় এই প্রতিবেদককে। মোনার্ক মার্টের অফিসে গেলে প্রতিষ্ঠানটির বিজনেস ডেভেলপার ম্যানেজার তৌহিদ আহমেদ সীমান্ত বলেন, আমরা কারণ দর্শানোর নোটিশ পেয়েছি এবং তাদের জবাবও দিয়েছি। আমরা আমাদের কোনো গিফট কার্ড বিক্রি করি না, অন্যদের গিফট কার্ড বিক্রি করি। অনুমোদনের বিষয়টি তাদের দায়িত্ব। বাংলাদেশ ব্যাংক মৌখিকভাবে গিফট কার্ড বিক্রি চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে আমাদের।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে মোনার্ক মার্টের এমন দাবি প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক কালবেলাকে বলেন, আমরা এ ধরনের মৌখিক কোনো কথা বলি না কাউকে।

হুটহাট কর্মী হ্রাস : মোনার্ক মার্টের বিরুদ্ধে হুটহাট কর্মী হ্রাসের অভিযোগ করছেন চাকরি হারানো কর্মীরা। ক্যারিয়ারে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে স্থায়ী চাকরি ছেড়ে মোনার্ক মার্টে যোগ দেওয়ার দুই মাসের মধ্যেই চাকরি হারানোর মতো অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে একাধিক কর্মীকে। কর্মীরা যেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা অন্য কোথাও এ বিষয়ে উচ্চবাচ্চ্য না করেন সেজন্য বকেয়া রাখা হয়েছে বেতন; দেওয়া হয়নি ছাড়পত্র। নতুন প্রতিষ্ঠানে যোগদানের সময় কর্মীদের কাছে পুরোনো প্রতিষ্ঠানের দেওয়া ছাড়পত্র চাওয়া হয়। মোনার্ক মার্ট কর্মীদের এমন ছাড়পত্র না দেওয়ায় নতুন প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেতেও সমস্যা হচ্ছে কারও কারও। এ অবস্থায় গণমাধ্যমেও পরিচয় উল্লেখ করে বক্তব্য প্রকাশে রাজি হননি কেউ।


মোনার্ক মার্টের একটি বিভাগের প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন–এমন এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ফুড ডেলিভারি বিষয়ক একটি ই-কমার্সে আমি চার বছর কর্মরত ছিলাম। সেই প্রতিষ্ঠানের দেশব্যাপী বিস্তৃতিতে কৌশলগত পরিকল্পনা ও সেগুলো বাস্তবায়নে আমার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। সেখানে থাকা অবস্থায় মোনার্ক মার্টের আরেক কর্মকর্তার মাধ্যমে এখানে যোগদানের প্রস্তাব পাই। ক্যারিয়ারে উন্নতি হবে ভেবে গত নভেম্বর মাসে আমি মোনার্ক মার্টে আসি। কিন্তু এখানে এসে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো সহায়তা পাচ্ছিলাম না। মালিকপক্ষ প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে যা বলত তার সঙ্গে আর্থিক অবকাঠামো অথবা কৌশলগত প্রান্তিককরণের কোনো মিল পাচ্ছিলাম না। এরপর ডিসেম্বরে ওই কর্মকর্তা চাকরি ছেড়ে দেন, যিনি আমাকে এখানে এনেছিলেন। উনি যাওয়ার পরপর ওনার মাধ্যমে আমিসহ যারাই মোনার্ক মার্টে এসেছিলাম, তারা সবাই ঝামেলায় পড়ে যাই। ম্যানেজমেন্ট এমন একটা পরিবেশ তৈরি করে যে, কর্মী নিজে থেকেই চাকরি ছেড়ে চলে যায়। আমি ছাড়াও আরও অন্তত ছয়জনকে এমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে দেখেছি, যারা সবাই প্রতিষ্ঠিত ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান থেকে মোনার্ক মার্টে এসেছিলেন।

এই কর্মকর্তা নিজের সঙ্গে হওয়া অমানবিক অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, আমি নভেম্বরে যোগ দিলাম আর ডিসেম্বরের ১৫ তারিখ মানবসম্পদ বিভাগ থেকে বলা হয়, কোম্পানি টিকে থাকতে পারছে না। আমাকে যে বেতন দেওয়া হচ্ছিল, সেটা তারা আর দিতে পারবে না এবং অনেক কম বেতন প্রস্তাব করে। পরে ডিসেম্বরের শেষ দিকে আমাকে পদত্যাগ করতে বলা হয়। নতুন চাকরি খোঁজার জন্য এক মাস সময় চাইলে তারা আমাকে মাত্র ১৫ দিন সময় দেয়। এখন পর্যন্ত আমি ডিসেম্বর এবং জানুয়ারির অর্ধেক মাসের বেতন পাইনি, ছাড়পত্র পাইনি। সাধারণত শেষ কর্মদিবসেই কর্মীদের ছাড়পত্র, অভিজ্ঞতা সনদপত্র বুঝিয়ে দেওয়া হয়। তাদের (মালিকপক্ষ) মন চেয়েছে, তারা কোম্পানি তৈরি করে ফেলছে। কর্মীদের নিয়ে তাদের কোনো চিন্তা নেই। এমন অভিজ্ঞতার কারণে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ছেড়ে দেশীয় প্রতিষ্ঠানে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্তকেই ভুল মেনে হতাশায় ভুগছেন এই তরুণ।

মোনার্ক মার্টের আরেক সাবেক বিভাগীয় প্রধান বলেন, ভালো কিছু করার উদ্দেশ্য নিয়ে মোনার্ক মার্টে যোগ দিই; কিন্তু তাদের ম্যানেজমেন্টের চাপে একপ্রকার বাধ্য হয়েই চাকরি ছেড়ে চলে আসতে হয়। গত ডিসেম্বরেই প্রায় সব বিভাগীয় প্রধানের মাঝে কাজ করার মানসিকতা নষ্ট হয়ে যায়। এরপর বেতন দেওয়া নিয়েও হয় গড়িমসি। অনেকে তাদের বেতন পেয়েছেন ভেঙে ভেঙে। প্রতিষ্ঠানের শুরু থেকে দেশের ই-কমার্সের জন্য দারুণ কিছু করার স্বপ্ন নিয়ে কাজ করা মানুষকে এমন বিদায় কোনো কর্মীই আশা করে না। এখন মোনার্কের প্রায় প্রতিটি কর্মীই প্রতিনিয়ত কোম্পানি বন্ধ হওয়ার শঙ্কায় কাটাচ্ছেন।

তবে এসব অভিযোগও অস্বীকার করেছে মোনার্ক মার্ট। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, যারা আর কর্মরত নেই তাদের সবার বেতন পরিশোধ করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, ২০২২ সালের জানুয়ারিতে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে মোনার্ক মার্ট। মোনার্ক মার্টকে মোনার্ক হোল্ডিংসের একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেসময় ঘোষণা দেওয়া হয়। মোনার্ক মার্টের চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান। মোনার্ক মার্টের পক্ষ থেকে জানানো হয়, গড়ে প্রতি মাসে প্রতিষ্ঠানটিতে প্রায় ১ কোটি টাকার বিকিকিনি হয়। প্রতি লেনদেনের গড় মূল্য অর্থাৎ টিকিট সাইজ প্রায় ৬০০-৭০০ টাকা। প্রায় ১ লাখ নিবন্ধিত গ্রাহক আর এক হাজারের মতো বিক্রেতা রয়েছে মোনার্ক মার্টের মার্কেটপ্লেসে।




আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top