মাত্র ২০ বসন্ত দেখে গেছেন—কিন্তু এই অল্প সময়েই পথ দেখিয়ে গেলেন আরও অগণিত মানুষকে। জ্বেলে গেলেন আশার আলো। দেশের চিকিৎসাক্ষেত্রকে যেন দিয়ে গেলেন সঞ্জীবনী শক্তি। দেশে প্রথম মরণোত্তর কিডনি দান করলেন এই ‘স্বর্গীয় সন্তান’। আর তাতে বাঁচল দুজনের প্রাণ।

চারজনের জীবনে আলো জ্বালিয়ে গেলেন সারাহ

সারাহ ইসলাম। দেশের প্রথম মরণোত্তর কিডনিদাতা। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

মাত্র ১০ মাস বয়সে আক্রান্ত হন দুরারোগ্য টিউবেরাস স্ক্লেরোসিস রোগে (বিরল জন্মগত রোগ, যেখানে দেহের বিভিন্ন স্থানে টিউমার হয় যা ক্যান্সার না)। এরপর প্রায় ১৯ বছর লড়াই করে গেছেন এ রোগ নিয়ে। অবশেষে সে লড়াইয়ের অবসান ঘটল গতকাল বুধবার।

মাত্র ২০ বসন্ত দেখে গেছেন—কিন্তু এই অল্প সময়েই পথ দেখিয়ে গেলেন আরও অগণিত মানুষকে। জ্বেলে গেলেন আশার আলো। দেশের চিকিৎসাক্ষেত্রকে যেন দিয়ে গেলেন সঞ্জীবনী শক্তি। আর বাঁচিয়ে গেলেন অন্তত দুজনের প্রাণ।

নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দান করে যাওয়ার এই 'বীর' তরুণীর নাম সারাহ ইসলাম ঐশ্বর্য। তার দান করে যাওয়া দুটি কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে দুজন রোগীর দেহে। শুধু কিডনি নয়, দেহের সবকিছুই দান করে গেছেন সারা। তবে তার কিডনি ও কর্নিয়া নেওয়া হয়েছে। সারাহই দেশে প্রথম মরণোত্তর কিডনি দান করলেন।

সারাহর কর্নিয়া দুটিও ইতিমধ্যে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। একটি কর্নিয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) চক্ষুবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রাজশ্রী দাশ সুজন নামের ২৩-২৫ বছর বয়সি যুবকের চোখে, অপর কর্নিয়াটি কমিউনিটি অপথালমোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শীষ রহমান ফেরদৌস আক্তার নামের ৫৬ বছর বয়সি এক নারীরে চোখে প্রতিস্থাপন করেন।

শৈশব থেকেই দুরারোগ্য ব্যাধি নিয়ে বড় হয়েছেন সারাহ। জীবন সহজ ছিল না। সমবয়সি অনেক শিশু তার মুখের টিউমার দেখে ভয় পেত, তার পাশে বসতে চাইত না। কিন্তু সেই বন্ধুর পথ পেরিয়েই মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়েছেন। ভর্তি হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে, পছন্দের বিষয় ফাইন আর্টসে। টিউমার নিয়ে লড়াই করে গেছেন এই বিশ বছর।

মেয়ের লড়াই নিয়ে সারাহর মা, শিক্ষিকা শবনম সুলতানা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, 'খুব কষ্ট পেত ও। ছোটবেলায় ওর মুখের এই টিউমারগুলো দেখে সবাই ভয় পেত। কোনো কোনো বাচ্চারা ওর পাশে বসতে চাইত না। [সারাহ] অনেক কষ্ট করেছে, অনেক কেঁদেছে।'

সারাহ জানতেন, তিনি দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত, বেশিদিন বাঁচবেন না। তাই মাকে বলে গিয়েছিলেন, 'প্রয়োজন হলে আমার ব্রেনও তুমি দান করে দিও আমার মৃত্যুর পর। সবকিছুই তুমি গবেষণার জন্য দিয়ে দিতে পারো, মা।'


তিন দিন আগে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় বিএসএমএমইউতে ভর্তি করা হয়ে সারাহকে। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় তাকে 'ব্রেন ডেড' ঘোষণা করা হয়। এরপর মেয়ের ইচ্ছামতোই মা শবনমও সারাহর অঙ্গ দানে সম্মতি দেন। বাংলাদেশে যা বিরল ঘটনা। দেশে সাধারণত 'ব্রেন ডেড' রোগীর আত্মীয়দের দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও অনিচ্ছার কারণে এতদিন মরণোত্তর কিডনি দান সেভাবে আলোর মুখ দেখছিল না। চিকিৎসকরা আশা করছেন, সারাহর দেখানো পথে মরণোত্তর কিডনি দানে উদ্বুদ্ধ হবে মানুষ।

'মিষ্টি প্রতিশোধ'
পেশায় শিক্ষিকা মা শবনম মেয়ে সারাহকে ছোটবেলায় বেশি সময় দিতে পারতেন না। পেশাগত দায়িত্ব পালনে প্রায়ই বাইরে থাকতে হতো। মাকে খুব মিস করত ছোট্ট মেয়ে।

সংবাদ সম্মেলনে শবনম সুলতানা বলেন, 'ওর ছোটবেলায় পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য আমাকে বাইরে থাকতে হতো—সে আমাকে খুব মিস করত। এখন সেজন্য সে বোধহয় প্রতিশোধ নিল। এখন আমাকে সারাহ জীবন—আমি যতদিন বেঁচে থাকব—ওকে কোনোদিন আমি ভুলব না। আমি ওকে মিস করতে থাকব। এটাই বোধহয় ওর খুব মিষ্টি একটা প্রতিশোধ আমার ওপর।'


দেশে প্রথমবারের মতো 'ব্রেন ডেড' রোগীর থেকে সফলভাবে কিডনি প্রতিস্থাপন
শবনম সুলতানা বলেন, 'সারাহ সত্যি সত্যি স্বর্গীয় সন্তান ছিল। যেখানে যেত, ব্যবহার দিয়ে সবাইকে মোহিত করে রাখত। ও বলেছিল, ''আমার সবকিছু গবেষণার জন্য দিয়ে দিতে পারো মা।'' সারাহর ইচ্ছা ছিল, ওর ব্রেন নিয়ে গবেষণা হোক।

'আমি সেই স্বর্গীয় কন্যার স্মরণে বলছি যে ও যেখানেই থাকবে, আল্লাহ তাকে অনেক অনেক ভালো রাখবেন।'

মেয়ের বিশ বছরের ছোট কিন্তু ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ অর্থবহ জীবন নিয়ে শবনম বলেন, '[সারাহ] অনেক কষ্ট করেছে, অনেক কেঁদেছে। ওর এই কান্না, ওর কষ্ট, ওর যন্ত্রণা, ওর বেদনা—সবকিছু ধুয়ে-মুছে যাক।'

'বীর' সারাহকে দেওয়া হোক মরণোত্তর সম্মাননা
সারাহর এই অসামান্য দানকে 'বীরোচিত' অভিহিত করেছেন বিএসএমএমইউয়ের প্রক্টর ও রেনাল ট্রান্সপ্লান্ট বিভাগের প্রধান অধ্যাপক হাবিবুর রহমান। তার মতে, সারাহর অবদান স্মরণীয় করে রাখতে প্রতীকী হিসেবে তাকে বীরের মর্যাদা দেওয়া উচিত সরকারের।

তবে শুধু সরকারের স্বীকৃতির অপেক্ষায় বসে নেই বিএসএমএমইউ। হাবিবুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, বিএসএমএমইউয়ের ক্যাডাভেরিক সেলের নামকরণ করা হবে সারাহর নামে। সেজন্য তারা একটি ফলকও তৈরি করছেন।

এছাড়া সারাহর পরিবারের সদস্যরা বিএসএমএমইউতে বিনামূল্যে চিকিৎসা পাবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

হাবিবুর রহমান বলেন, 'কিডনিদাতার অভাবে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ অল্প বয়সে মারা যায়। সারাহর দেখানো পথে যদি ব্রেন ডেথ রোগীর স্বজনেরা এগিয়ে আসে, তাহলে অনেক মানুষ বেঁচে যাবে। সারাহ দিয়ে আমরা সেই অগ্রযাত্রাটা শুরু করতে চাচ্ছি।'


কিডনি প্রতিস্থাপন করা দল।
সারাহর অবদান নিয়ে বিএসএমএমইউয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ এক বিবৃতিতে বলেন, 'ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্ল্যান্টের প্রথম অঙ্গদাতা সারাহ ইসলামের নাম বাংলাদেশের চিকিৎসাক্ষেত্রে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তার এই মহৎ আত্মত্যাগের মহিমা চিকিৎসা বিজ্ঞানে ভাস্মর হয়ে থাকবে।'

সারাহর অবদান কেন গুরুত্বপূর্ণ
সারাহর এই অবদান কেন এত গুরুত্বপূর্ণ, তা জানার আগে জেনে নেওয়া যাক কিছু তথ্য।

দেশে কোনো না কোনো কিডনি রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় দুই কোটি। যাদের অনেকেই দাতার অভাবে কিডনি প্রতিস্থাপন করতে না পেরে মারা যায়।

২০১৯ সাল থেকে দেশে মৃত ব্যক্তির দান করা কিডনি প্রতিস্থাপনের উদ্যোগ নেয় বিএসএমএমইউ। কিন্তু কয়েকবার দাতা কিডনি ডানে সম্মতি দিলেও তাদের মৃত্যু পর কিডনি পাওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে তাদের আত্মীয়দের অনীহায় প্রতিস্থাপন করা যায়নি।

দাতার অভাবে এতদিন ধরে দেশে আইনের ফাঁক গলে অবৈধভাবে কিডনি বেচাকেনা হচ্ছিল। একটি কিডনি কিনতে কয়েক লাখ টাকা লাগে। অবৈধভাবে কিডনি কেনাবেচার চক্রও গড়ে উঠেছে।

এখন সারাহর কিডনি দানের পর ব্রেন ডেথের রোগীদের আত্মীয়-স্বজনরা ধীরে ধীরে কিডনি দানে উৎসাহিত হবে বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা। এতে বাঁচবে অজস্র মানুষের প্রাণ। সারাহ পথ দেখিয়ে গেছেন, এখন তার দেখানো পথ ধরে এই কিডনি দানকে সামাজিক আন্দোলনে রূপ দিতে হবে বলে মন্তব্য করেন চিকিৎসকরা।

 




আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top