346

05/05/2024 বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৯:৪৫

একের পর এক ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছে তুরস্ক ও সিরিয়া। ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে লাশের সারি। ভূতাত্ত্বিক অবস্থানের কারণে বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশও। যে কোনো সময়ে হতে পারে ৮ মাত্রার পর্যন্ত ভূমিকম্প। বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শহরের তালিকায় থাকা ঢাকা এমন দুর্যোগ সামলাতে প্রস্তুত নয়। ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে রাজধানী। ধসে পড়বে দেড় লাখ ভবন, মৃত্যু হবে অন্তত দুই থেকে তিন লাখ মানুষের। ঘনবসতির এই শহরটির ঝুঁকি কমাতে নানা উদ্যোগের কথা বলা হলেও এর বেশিরভাগই আলোর মুখ দেখেনি।

আর্থ অবজারভেটরি সেন্টারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারত, ইউরোপিয়ান ও মিয়ানমার এই তিনটি প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। যেসব প্লেট কয়েকশ বছর ধরে শক্তি সঞ্চয় করছে। ফলে এখানে যে কোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা হতে পারে ৮।

মাঝেমধ্যেই ছোট ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠছে সারা দেশ। গত ১৫ বছরে ছোট-বড় ভূমিকম্পে ১৪১ বার কেঁপে ওঠে দেশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছোট ভূকম্পন বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত দিচ্ছে। বড় ভূমিকম্পের শতবছরের মধ্যে আরেকটি বড় ভূমিকম্প হয়। সে হিসাবে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা প্রকট। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, বহু পুরোনো ভবন, অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ, ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড অনুসরণ না করায় ভূমিকম্প ঝুঁকি কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের এক যৌথ গবেষণায় দেখা যায়, ভারতের আসামে ১৮৯৭ সালে রিখটার স্কেলে ৮ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প আঘাত হানলে ২৫০ কিলোমিটার দূরে ঢাকার ১০ ভাগ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামালের গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকা শহরের ৩০৫ বর্গকিলোমিটার এলাকার ৩৫ শতাংশ মূলত লাল মাটি। বাকি ৬৫ শতাংশ এলাকা নরম কাদামাটি ও বালুমাটি এলাকা। ৫-৬ মাত্রার ভূমিকম্প হলেই ঢাকার নরম মাটিতে তৈরি এসব ভবন ভেঙে বা হেলে পড়তে পারে।


তুরস্ক-সিরিয়ায় ভূমিকম্প : প্রাণহানি ১২ হাজার ছাড়িয়েছে
২০০৯ সালে সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি-সিডিএমপি ও জাইকার যৌথ জরিপে জানা গেছে, ঢাকায় সাত বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হলে শহরের ৭২ হাজার ভবন ভেঙে পড়বে এবং এক লাখ ৩৫ হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তৈরি হবে সাত কোটি টন কংক্রিটের স্তূপ।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৫৭টি ভূমিকম্পের প্রভাবে কেঁপেছে বাংলাদেশ। সর্বশেষ গত ৫ ডিসেম্বর সকাল ৯টা ২ মিনিট ৫৩ সেকেন্ডে ভূমিকম্পে কাঁপে দেশ। রিখটার স্কেলে ৫ দশমিক ২ মাত্রার এই ভূমিকম্পের উৎসস্থল ছিল বঙ্গোপসাগর। ২০২১ সালের ২৯ মে এক দিনেই টানা ছয় দফা মৃদু ভূমিকম্পের কারণে সিলেট শহরসহ আশপাশের এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এসব কম্পন বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে সিলেট, ময়মনসিংহ এবং রংপুর, ঢাকা, কুমিল্লা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের কিছু অংশ। এর মধ্যে সিলেট বিভাগের চারটি জেলা বড় মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। একইভাবে ময়মনসিংহ বিভাগের পাঁচটি জেলাও ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ঢাকা বিভাগের মধ্যে টাঙ্গাইল, গাজীপুর, নরসিংদী জেলার অংশ বিশেষ, পুরো কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা উচ্চ মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। এ ছাড়া ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে আছে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি জেলার উত্তরাংশ।

মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে ঢাকা, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, কুমিল্লা, চাঁদপুর, ফেনী, নোয়াখালী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, নওগাঁ, রাজশাহী, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের অংশবিশেষ, চট্টগ্রাম, বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলা। ভূমিকম্পের কম ঝুঁকিতে রয়েছে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পুরো খুলনা ও বরিশাল বিভাগ।

ক্ষুধা সূচকে মাঝারি অবস্থানে বাংলাদেশ
প্রতিবারই বড় কোনো ভূমিকম্প হওয়ার পরই ব্যাপক তৎপরতা দেখা যায়, যা ধামাচাপা পড়ে থাকে বড় ধরনের আরেকটি ভূমিকম্প আঘাত হানার আগ পর্যন্ত। ২০১৫ সালে নেপালে উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পের প্রভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছিল। সে সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাউন্সিলের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল ‘ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার’ প্রতিষ্ঠার। সেই সিদ্ধান্তটি এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। এ ছাড়া ওই বৈঠকে ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এনডিএমআইএস) নামে একটি ওয়েবসাইট তৈরির সিদ্ধান্তও হয়েছিল। এটিও আলোর মুখ দেখেনি।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, গত দু-তিন বছরে দেশে ভূমিকম্প অনেক বেড়েছে। আবার ১০০ বছরের মধ্যে আমাদের এখানে তেমন বড় ভূমিকম্প হয়নি। এটা আতঙ্কের বিষয়, তার মানে ছোট এসব কম্পন শক্তি সঞ্চয় করছে। ৮ মাত্রায় ভূমিকম্প হলে রাজধানীর প্রায় ২৫ ভাগ ভবনই ধসে পড়বে। তুরস্কে যে ভূমিকম্প হয়েছে, এর চেয়ে ছোট, অর্থাৎ রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলেও শুধু ভবন ধস নয়, ঢাকার অপরিকল্পিত বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও গ্যাসলাইন এ নগরকে একটি অগ্নিকূপে পরিণত করতে পারে।

অধ্যাপক আনসারী বলেন, ভূমিকম্পে ৯০ শতাংশ মানুষ মারা যায় ভবন ধসে। দ্রুত দেশের ২০ লাখ বহুতল ভবনের সবকটিকে ভূমিকম্প-সহনশীল করতে হবে। সারা দেশে বড় বড় শহরে সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে সেখানকার বাসাবাড়ি ভূমিকম্পন সহনীয় কিনা, সেটা যাচাই করতে হবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতাত্ত্বিক বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. মাহফুজুল হক বলেন, গত দুই দশকে ঢাকার নগরায়ণ প্রক্রিয়ায় পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের যেসব এলাকায় নগরায়ণ হয়েছে, সেসব এলাকার মাটির বৈশিষ্ট্য ও ভূতাত্ত্বিক গঠন নগরায়ণের উপযোগী নয়। ফলে ভূমিকম্প হলে বছিলার মতো এলাকায় দুর্যোগ ও ক্ষয়ক্ষতির শঙ্কা অনেক বেশি। ঢাকার ভূমিতলের উচ্চতা ৫ থেকে ১৮ মিটারের মধ্যে। যথাযথভাবে ‘ভূমি উপযোগিতা বিশ্লেষণ’ না করে বর্তমানে নগরায়ণ হওয়াতে সামনের দিনে নগর দুর্যোগের শঙ্কা প্রতিনিয়ত বাড়ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ভূতত্ত্ববিদ সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, মাঝারি মানের ভূমিকম্প হলে ঢাকায় জলাভূমি ভরাট করে নির্মিত ভবনগুলো ভেঙে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটতে পারে। শহরের অপরিকল্পিত ভবন ও সরু সড়কের কারণে ফায়ার সার্ভিস এবং স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য উদ্ধার তৎপরতা চালানোও কঠিন হবে। তা ছাড়া ভূমিকম্পের সময় খোলা জায়গা না থাকা, মাঠ বা উদ্যান না থাকার কারণে ভবন ছেড়ে বের হয়েও দুর্ঘটনার হুমকিতে থাকবে মানুষ। পরিকল্পিত বাড়িঘর নির্মাণের দিকে ফিরে যাওয়াই হচ্ছে আগাম সতর্ক ব্যবস্থা। সেদিকেই জোর দিতে হবে।

সরকারি কর্মকর্তাদের কর্মকৃতি মূল্যায়নে শুরু হচ্ছে পাইলটিং
তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিস, ভূমিকম্প ব্যবস্থাপনা বাহিনীকে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সব সময় প্রস্তুত রাখতে হবে। এ ছাড়া ভূমিকম্পের পর দেশের উপকূলীয় এলাকায় সুনামির আশঙ্কা থাকে। তাই পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ ও হাসপাতালগুলোকে আধুনিক করতে হবে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, ভূমিকম্পসহ যে কোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় দেশের সব বাহিনী প্রস্তুত আছে। এখন ২০-২২ তলা পর্যন্ত ওঠা যায় এমন ল্যাডার (মই) দেওয়া হয়েছে। আধুনিক ওয়্যারলেস কেনা হয়েছে। প্রায় ৬০ হাজারের বেশি ভলান্টিয়ার রয়েছে ভূমিকম্পের সময় কাজ করার জন্য। বছরে দুবার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। মহড়া কার্যক্রম চলমান রয়েছে। মানুষও আগের চেয়ে সচেতন। তিনি বলেন, ভূমিকম্প সহনশীল ভবন নির্মাণে নতুন ইমারত নির্মাণ বিধিমালা করা হয়েছে। এটি মানা হলে দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা যাবে।

সম্পাদক:
যোগাযোগ: ৩২/২, প্রিতম জামান টাওয়ার, (১১ তলা), পুরানা পল্টন, ঢাকা - ১০০০
মোবাইল: +৮৮ ০১৭৮৭ ৩১৫ ৯১৬
ইমেইল: infobanglareport@gmail.com