টাকা ছিনতাইয়ে ভাড়াটে যখন পুলিশ!
টাকা ছিনতাইয়ে একের পর এক পুলিশ সদস্যের জড়িত থাকার অভিযোগ যেন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকের নামে মামলাও হয়েছে, কেউ রিমান্ডে স্বীকারও করেছেন ছিনতাইয়ে জড়িত থাকার কথা, কেউবা কারাগারে। সম্প্রতি এ ধরনের বেশ কয়েকটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। পুলিশের এহেন কর্মকাণ্ডে অনেকে আশ্চর্য হলেও তাদের বিচারের আওতায় আনার দাবি করছেন ভুক্তভোগীরা।
মাইক্রোবাসে তুলে ব্যবসায়ীর ৫৪ লাখ টাকা ছিনতাই
গত ৮ অক্টোবর সকাল ৯টা। ব্যবসায়ী আবুল কালামের নাতি তানভীর হোসেন নয়ন ব্যাগে করে ৫৪ লাখ টাকা মতিঝিলের জনতা ব্যাংকে জমা দেওয়ার জন্য রওয়ানা হন। হেঁটে শ্যামপুরের ধোলাইপাড় ইউনিকেয়ার হাসপাতালের সামনে পৌঁছালে দুই ব্যক্তি তার পথরোধ করেন। এরপর তাকে জোর করে মাইক্রোবাসে তুলে মাওয়াগামী রোডে যান। আব্দুল্লাহপুর পার হয়ে রসুলপুরে ফাঁকা রাস্তায় তাকে হুমকি দিয়ে ৫৪ লাখ টাকা কেড়ে নেন। এসময় তারা মোবাইলও কেড়ে নেন এবং তাকে ফাঁকা রাস্তায় ফেলে দ্রুতগতিতে গাড়ি নিয়ে সটকে পড়েন। এ ঘটনায় পুলিশের দুই কনস্টেবল মো. দেলোয়ার হোসেন ও মো. আবু সায়েমসহ চারজনকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অন্য দুজন হলেন আসামি মো. মোশারফ হোসেন ও মো. আ. বাতেন।
মামলার বাদী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, আমি প্রথমে শুনে আশ্চর্য হয়ে যাই। পুলিশ সদস্যরা এ ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত, ভাবতেই পারছিলাম না। প্রথমে মনে করেছিলাম, আমার কর্মচারীর (আজিমের) বিরুদ্ধে মামলা থাকতেও পারে। তাৎক্ষণিকভাবে আমি পুরো বিষয়টি পুলিশকে জানাই। পুলিশ দ্রুত সময়ের মধ্যে টাকা উদ্ধারসহ আসামিদের গ্রেফতার করে। এজন্য পুলিশ ভাইদের ধন্যবাদ জানাই। যারা ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের এসআই রফিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ব্যবসায়ীর ৫৪ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনায় করা মামলায় দুই পুলিশ কনস্টেবলসহ চারজনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের মধ্যে দুই পুলিশ সদস্যকে দুদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। বাকি দুজন আদালতে দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। মামলার তদন্তকাজ অব্যাহত রয়েছে।
ব্যবসায়ীর ২০ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনায় পুলিশ
গত ২১ সেপ্টেম্বর দুপুর ২টা তখন। আইএফআইসি ব্যাংকের পল্টন শাখা এলাকা থেকে ২০ লাখ টাকা লুটের ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশকে জানালে সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে প্রথমে আসামি হৃদয়কে গ্রেফতার করেন তারা। পরে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কনস্টেবল মাহাবুব ও আছিফকে লুটের ১০ লাখ টাকাসহ গ্রেফতার করে পুলিশ। এরপর বাসাবো এলাকা থেকে শাজাহান ও রাসেলকে গ্রেফতার করা হয়। জব্দ করা হয় ছিনতাইয়ে ব্যবহৃত মোটরসাইকেল। এ ঘটনায় ব্যবসায়ী আবদুল্লাহ আল মামুন বাদী হয়ে পল্টন মডেল থানায় মামলা করেন। মামলায় ডেমরা পুলিশ লাইনসের দুই কনস্টেবল মাহাবুব আলী ও আছিফ ইকবাল এবং তাদের তিন সহযোগী শাজাহান, হৃদয় ও রাসেলকে আসামি করা হয়। এরপর তাদের দুদিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়। রিমান্ড শেষে তারা কারাগারে।
পুলিশের হায়ার অথরিটি থেকে নিম্ন পর্যন্ত তারা প্রায়ই বিভিন্ন দুর্নীতি করে। ছোট দুর্নীতি যারা করে তাদের হয়তো আমরা ধরে ফেলি, তাদের ধরা সহজ। কিন্তু ওপরের লেভেলেও অনেক দুর্নীতি আছে, যেগুলো আমাদের কাছে পৌঁছায় না বা পৌঁছালেও আমরা প্রকাশ করি না৷ বড় থেকে ছোট পর্যন্ত এমন কালচার আছে, কোনোটা হয়তো প্রকাশ হয় কোনোটা আবার হয় না। অনেক সময় মানুষ মামলাও করে না।— শাহেরা আফরিন
মামলার বাদী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, আমি প্রথমে শুনে আশ্চর্য হয়ে যাই। পুলিশ সদস্যরা এ ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত, ভাবতেই পারছিলাম না। প্রথমে মনে করেছিলাম, আমার কর্মচারীর (আজিমের) বিরুদ্ধে মামলা থাকতেও পারে। তাৎক্ষণিকভাবে আমি পুরো বিষয়টি পুলিশকে জানাই। পুলিশ দ্রুত সময়ের মধ্যে টাকা উদ্ধারসহ আসামিদের গ্রেফতার করে। এজন্য পুলিশ ভাইদের ধন্যবাদ জানাই। যারা ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। যেন ভবিষ্যতে পুলিশ বাহিনীর কোনো সদস্য এমন নিকৃষ্ট কাজে না জড়ায়।
ডিএমপির অপরাধ ও প্রসিকিউশনের তথ্য বলছে, ছিনতাই, জালিয়াতি ছাড়াও ডাকাতির প্রস্তুতির অভিযোগে সূত্রাপুর থানায় এএসআই নিজাম হাওলাদার ও কনস্টেবল শেখ সাদীর বিরুদ্ধে ভুয়া সরকারি কর্মচারী পরিচয় দিয়ে অপহরণের অভিযোগে যাত্রাবাড়ী থানায় মামলা হয়। এরমধ্যে শেখ সাদীকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের একটি সিআর মামলায় এক বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। এছাড়া জয়পুরহাট ও মানিকগঞ্জে তার বিরুদ্ধে আরও দুটি সিআর মামলা রয়েছে। বর্তমানে তিনি পলাতক। বিচারকের সই জালিয়াতির ঘটনায় ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শেখ সাদীর সই জাল করে পরোয়ানা ফেরত কাগজে নিজেরাই সই দেওয়ায় পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) মো. ফুয়াদ উদ্দিন ও কনস্টেবল আবু মুসার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। বর্তমানে তারাও পলাতক।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার ড. খ. মহিদ উদ্দিন বলেন, যেসব পুলিশ সদস্য অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে তাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে ডিপার্টমেন্টাল ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। অপরাধ যেই করুক তার কোনো ছাড় নেই।
ঢাকা মহানগর আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) তাপস কুমার পাল বলেন, কিছু অসাধু পুলিশ সদস্য টাকা ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে। এতে পুরো পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। পুলিশ বাহিনীর শীর্ষদের এ বিষয় তদারকি বাড়াতে হবে। যারা অপকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন তাদের কঠিন শাস্তির আওতায় আনতে হবে। যাতে অন্যরা এ ধরনের অপরাধে না জড়ায়।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আল মামুন রাসেল বলেন, আমি মনে করি, এটি পুলিশকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতারের যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তার অপব্যবহার। পুলিশের অতি ক্ষমতায়ন এবং সাধারণ মানুষের পুলিশ ভীতির কারণও রয়েছে। সাধারণ মানুষ পুলিশকে জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসতে পারে না, পুলিশ দেখলেই ভয় পায়। এই দুর্বলতার সুযোগে মানুষকে জিম্মি করে ছিনতাইয়ের মতো জঘন্য কাজে লিপ্ত হয় পুলিশ সদস্যরা। কোনো মামলা হলে মানুষের বাসায় গিয়ে মামলার রিলেটেড জিনিসপত্র ছাড়াও অন্যান্য জিনিসপত্রও নিয়ে চলে আসে, যা সিজার লিস্টেও যোগ না করে নিজেরা ভাগাভাগি করে নিয়ে যায়। শুধু কঠোর শাস্তির আওতায় নিয়ে এলে হবে না এর সঙ্গে সাধারণ মানুষের ভীতি দূর করতে পারলেই অপরাধ কমে যাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শাহেরা আফরিন বলেন, পুলিশের অতীত ইতিহাসের দিকে যদি তাকাই, তাহলেও দেখতে পাবো, নানা নধরনের ক্রাইমের সঙ্গে তারা যুক্ত হয়। যেগুলো খুব কমন যেমন মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেবো বলে ভয় দেখিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া বা পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন। এ ধরনের ক্রাইমগুলো কিন্তু খুব বেশি দেখেছি। আবার চাঁদাবাজি বা মাদক দিয়েও মামলা দেয় তারা। এগুলোর সঙ্গে আমরা মোটামুটি পরিচিত। পুলিশের হায়ার অথরিটি থেকে নিম্ন পর্যন্ত তারা প্রায়ই বিভিন্ন দুর্নীতি করে। ছোট দুর্নীতি যারা করে তাদের হয়তো আমরা ধরে ফেলি, তাদের ধরা সহজ। কিন্তু ওপরের লেভেলেও অনেক দুর্নীতি আছে, যেগুলো আমাদের কাছে পৌঁছায় না বা পৌঁছালেও আমরা প্রকাশ করি না৷ বড় থেকে ছোট পর্যন্ত এমন কালচার আছে, কোনোটা হয়তো প্রকাশ হয় কোনোটা আবার হয় না। অনেক সময় মানুষ মামলাও করে না।
কিছু অসাধু পুলিশ সদস্য টাকা ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে। এতে পুরো পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। পুলিশ বাহিনীর শীর্ষদের এ বিষয় তদারকি বাড়াতে হবে। যারা অপকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন তাদের কঠিন শাস্তির আওতায় আনতে হবে। যাতে অন্যরা এ ধরনের অপরাধে না জড়ায়।
তিনি আরও বলেন, আমরা কোনো একটা কাজ করার আগে দেখি এ কাজে কতটুকু বেনিফিট ও কতটুকু রিস্ক। যদি দেখি রিস্কের চেয়ে বেনিফিট বেশি, তাহলে আমি সেই রিস্কটা নেই। এখানে পুলিশের কাছে মনে হয়েছে, তারা যেহেতু পুলিশে আছে তাই তারা এসব করে পার পেয়ে যেতে পারবে। তারা হয়তো প্রিভিয়াস কেসগুলো দেখেছে যে, এগুলো করলে তেমন কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয় না বা পায় না। মানুষ সেগুলো এনালাইসিস করে। যখন তারা মনে করে এ কাজে রিস্ক নেই, জবাবদিহিতা নেই, তখনই তারা এসবে উদ্বুদ্ধ হয়। যদি একজনের বড় শাস্তি হতো, তাহলে বাকি দশটা পুলিশ সাবধান হয়ে যেত।
অধ্যাপক শাহেরা আফরিন আরও বলেন, পুলিশের ট্রেনিংয়ের বিষয়ও আছে। আপনি শুধু ফিজিক্যাল ট্রেনিং দিয়েই দক্ষ করতে পারবেন না। এটা শুধু পুলিশেই না। সব প্রফেশনেই কিন্তু সাইক্লোজিক্যাল মোটিভেশন, কাউন্সেলিং ইত্যাদি দরকার। কারণ পুলিশকে নানা ধরনের ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়। আপনি যদি কাউন্সেলিংয়ের ভেতর না থাকেন, তাহলে কিন্তু খুব সহজেই অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারেন। আপনাকে পুলিশে নিয়োগ দিয়ে দিলাম, এখানেই শেষ। এ রকমের হলে তো যে যা খুশি তা করবে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: